মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৩

মেলা


মাঝরাতের আকাশটা ঝকঝক করছে তারার মেলায়। গাঢ় অন্ধকার চারপাশে তাই হয়তো আকর্ষণটা আরো রহস্যময় হয়ে উঠছে। যে কারণে গাড়ির শীতলতা থেকে বেড়িয়ে আকাশে দৃষ্টি ফেলে দাঁড়িয়েছি। কত বিচিত্র রঙের খেলা মহাশূন্য জুড়ে! কি আছে ঐ অজানা সাজানো হীরকদ্যুতির মেলায়, কখনোই হয়তো জানা হবে না সে’ অযুত লক্ষ নক্ষত্র তারকারাজির কথা। দূর থেকে যা বহু দূর! শত আলোক বর্ষ দূরের সে জগত!

জানা হয়নি আমার মানুষটির মন আজও অবিকল ঠিকঠাক গড়নে আছে কি’বা নাই, যে থাকে হয়তো পৃথিবীর পরে, ধুলোর ভুবনে। স্থানাঙ্কে সে কোথায় জানি না। আছেই জেগে হয়তো আশে পাশে। তবু আমি তাকে খুঁজে ফিরি ধরাধামের বিদ্যাপীঠে, আর এক সময় টের পাই বাস্তবতা বড্ড কঠিন। তখন আমার নাসারন্ধ্র বেয়ে উঠে আসে হিম বাতাসের নোনা ঢেউ, মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে যায় সুতীক্ষ্ণ শীতল যন্ত্রণার সাইরেন। রোমকূপের প্রগাঢ় পেলব অনুভবে টের পাই শৈত্যপ্রবাহের কনকনে শীতের হুল, অসাড় করে তুলে হাত-পা, যদিও পাই চেতনা জগত আজো সবল। আহরণ করতে চাই অচেনার সকল স্বাদ-গন্ধ-শব্দ অথচ হিম কুয়াশার মতো আলতো পরশের চাদর জড়িয়ে যায় আমার শরীরে ইচ্ছে স্রোত, খামচে ধরি পিঠ, কুঁড়ে-কুঁড়ে খেতে চাই ধনুক বাঁকানো মেরুদণ্ড। কিছুই করা হয়ে ওঠে না, অসহ্য যন্ত্রনায় একটা সময় কুঁকড়ে যেতে যেতে নিজেকে ভ্রূণ বানিয়ে ফেলতে গিয়ে একসময় বিশভ্রহ্মাণ্ডের রহস্য জগতের সুর ভাজি, তাতে আমি নিজেরই রহস্যময়তার অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়ার দরজা খুলে যাওয়া টের পাই। এখনও সময় হয়নি বলে, আমি তার ছায়ার দিকে তাকিয়ে উত্তপ্ত ঘরের দরজা খুলে ঢুকে যাই ভাবনাকে বুকপকেটে জড়িয়ে। এমনি করেই রাত কাটে— স্বপ্ন ঘোর।

রাতের পরে ভোর আসে। এক যুগ আগে উদয় হওয়া সূর্যের রং আর আজকের সূর্যের রং এক নয়। আজকে মাটির অনেক কাছে আছি, একাকী আছি অনেক দিন যাবত ই কিন্তু তোমার থেকে খুব বেশী দূরে নয়। এখানে যে উদ্দেশ্যে আসা সেটা মনের এক বিবর্ণতা থেকে চাওয়া সাধ- যা লুপ্ত ছিলো মনের গহীনে, অবুঝ চেতনাগুলো সবসময় যেমন নীরবতায় লুকিয়ে থাকে তেমনটি নয়। হয়তো লিখে বোঝাতে পারি না দহনের কাষ্ঠপোড়ায় হৃদয়তলে জমেছে কত কালি, দেখাতে পারি না সময়ের প্রতিঘাতে অনুভবের আঙিনায় ধুসর বায়ুর প্রবাহ কতটা পাণ্ডুর আর তুমিও জানবে না কখনোই, শুষ্ক স্রোতে বয়ে যায় আমার অশান্ত চোখে একাকী কতশত নীরব বিপ্লব, জীবনহীন তানের সুরে বাজে প্রাণ, বেতান করুণ কিন্নরী। জানিস্ অণিমা! আজকে সূর্য ডোবার পরই দিনটি ফুরিয়ে যাবে; বছর ঘুরে হয়তো এদিনটি আসবে। হয়তো আজকের দিনটি নিয়ে যাবে আগামীর এ দিনটির কাছে। তবু এই যে এখানে আছি, দিন কাটে উদাস, মনে বৈকালিক হাওয়া, দূর্বাঘাসে ছড়িয়ে দিয়ে পা। এ খুবই উচ্চমাপের বিড়ম্বনা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি আসে এখানে, আমি ভিজে যাই, ভেজে আমার চুল, চিবুক, গাল। ভেজা পথে পায়ের ছাপ পড়ে আর তা আঁকতে আঁকতে চলে যাই বহুদূর। একসময় হঠাৎই টের পাই আমার এ সমস্ত ভেজা শরীর জন্মের বাস্তবতা আর বৃষ্টি হলো প্রকৃতির আত্মা। তখন নিজের বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয় জাগে, কিন্তু মাধুরী-বৃষ্টি? তাকে মনের অতলে একটু খানি জায়গা নিয়ে লুকিয়ে রাখি। বৃষ্টি বাঁধ না মানতে চাইলে চোখের কোনো পর্যন্ত এসে যায়, তবে কখনোই শরীর ভিজিয়ে দিতে পারে না। তবু এতোসব সমস্যার রানী থামাতে পারেনি হৃদয়ের মধ্যে টগবগ টগবগ করে ছুটে চলা দুর্বিনীত উচ্ছ্বাস।

যা এখন কেউ জানলেও বা না-জানলেও আমার কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। হয়তো এই অ-দেখাদেখি’তেই জীবনের বেলা ফুরিয়ে যাবে, অদেখার মাঝে নিয়তির ভবিষ্যৎ পরে থাকবে অচল পয়সার মতো। তাইতো বন্ধ সিন্ধুকের কোণে প্রহর গুনি সমাজের বেহিসেবী তালে-রঙে যা অসম্ভব আর বেশ বেমানান। অহর্নিশ জীবনের নামে কতই না বলি হয় জীবনের পাপ-পুণ্য। কে তার খবর রাখে? আজ ছেঁড়া পাদুকার মত সময়কে ছুড়ে ফেলতে পারি দুয়ারের বাইরে তোরই অস্তাচলে- আঁধার যে করেছি আপন! দখিনা বাতাসের চটুল ঘূর্ণি আমার বাতায়নে এসে হাহুতাস করে কেঁদে মরে আমি বলি- ধুর পাগলী, চিন্তা করিস না, নিয়তির শৃঙ্খল খুব সহজেই যায় না ভেঙ্গে ফেলা। তার চাইতে অধিক জোড়ে হেসে ঘুণে ধরা চৌকাঠ কাঁপাই- দেখ্ অণিমা আমার চোখের আঙিনায় কত হীরা-মানিক স্বপ্নহীন খেলা করে, কত তৃষ্ণা বিতৃষ্ণার দহন বিষাদ পুলকের ঢেউ তোলে। তাই হৃদয়ের কথা নিয়ে কোনো আবেদন করি না, কোনো হাহাকারের প্রতিশব্দে গুঞ্জন তুলি না, নেই কোনো অনুযোগ, অভিলাষের মৃদুমন্দ মায়ার দোলা উড়াই না চপল বধূর আঁচল, নেই কোনো আকাঙ্ক্ষার খরগ্রোতা আবেগের বান, কোনো অভিযোগ নেই, কোনো আষাঢ়-শ্রাবণের আমাবস্যা নেই, নেই কোনো রাতের বিরহী ঘ্রাণ অথবা অবিকশিত ফুলের ঝরে যাওয়া রোদন। দেখাবো না কখনো অদেখা তৃষ্ণার বানে কতটা রিক্ত ’এ প্রাণ, নয়নের জল নয়নে লুকিয়ে বরং দীর্ঘশ্বাসের দহনে জ্বালা মেটাবো তবু বলব না আমার হৃদয় তলে চুপটি করে বস্। 

এখন অগ্রহায়ণের আহ্লাদী পরানে বলি- ওহে দখিনা বাতাস, যা বয়ে যা সুখের আঙিনায় যেথায় পাঁচমিশালী সুখের পসরা বসায় নিত্যদিনের বাজার। কাশবনের মত হাওয়ায় ছুঁইয়ে দে মনের পরতে পরবে রঙধনু, শুভ্রমেঘের আলপনায় স্বপ্নসখী আঁকুক তুলিতে; স্বপ্ন বাসর। পোয়াতী পালে ভাটিয়ালের সুর মুছিয়ে দিক ভরাট গলার আবৃত্তি। শুক্লপক্ষের আমাবস্যা আমার থাকুক, এইতো আমার প্রাপ্তি, এইতো আমার কামনার সুখ, আধার রঙে দুঃখ তরুর বল্কল খসা ভঙ্গুরছাপ বেশ মানিয়েছে এ জীবনের গহীনতর উপলব্ধির অনুপ্রাণনে; তুই বরং আসিস না।মনে করিস না- ধরার জগতে এ মরার প্রলাপ।মনে করিস- এ ছিলো কোনো এক নষ্ট মনের অকারণই দুখ:বিলাস। অঞ্জন সাজে নয়নের বিজন কালো বাজিয়ে যাক অতৃপ্ত সুরে এক অভিলাষী ধৃষ্টতার বৈরাগী একতারা, আমি যে আর কেখনোই সুর হতে পারবো না!!!