বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৩

শুনছো

কড়িকাঠে কে যেন আমায় গেঁথে দিয়েছিলো, রশিতে শিকে ঝোলাবে বলে। সেই থেকে আমি পূর্ব পুরুষের সাক্ষী হয়ে ঝুলে আছি আর আমার শিকেতে ঝুলানো করোটিতে খুব যত্ন করে বৌ-ঝি’রা দৈ পাতছে। আমার দেহে আজ কত ঝঙ ধরেছে কে তার খবর রাখে? কোনো একদিন হয়তো ভার সইতে না পেরে ভেঙ্গে পড়বো। তবে এখন প্রাণ দিয়ে যত্ন করছে বলেই পুই উঠেছে লতিয়ে দেহ। ভালো লাগে না এসব নিয়ে ভাবনা করতে। উদাসী হয়ে গিয়েছি বাউলিনী তোমার টানে। দু’চোখে নি:স্পৃহার অন্ধ আলো জ্বেলে তাকিয়ে থাকি অনিমেষ, সাপের চোখের মতো হতে পারে কারণ পলক ফেলতেও আজকাল ভুল হয়ে যায়। ভালো লাগে না কিছুই। কেনই বা লাগবে বলো? আমিতো চাইনি ভালবাসা ছুঁয়ে দিতে। বেশ তো ছিলাম সামন্ত প্রভু হয়ে। যেই না তুমি বললে— ‘ভালোবাসি একদম নি:স্বার্থ ভালবাসা, কোনো বিনিময় চাই না, কোনো দেবতা সংহতি নেই আমার। কোনো বেড়াজালে আবদ্ধ রাখবো না তোমাকে লেখা-ঝোকা সংবিধানে।’ আমি অবাক হয়েছি জেনে। তুমি খুবই মৌনতায় এক তরফা ভাবে ভালবেসে গিয়েছো গত দু’টি বছর। আমাকে বুঝতে দাওনি, অথচ নজর রেখেছো সুখ দু:খের সাথী হয়ে। আমি টের পাইনি। কেমন করে পারলে আমার সব কিছু ওলট পালট করে দিয়ে দূরে সরে যেতে! জানি খুব দূরে তুমি নও আড়ালেই আছো, ডাকলেই চলে আসবে। সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে লজ্জা আনত দৃষ্টি মেলে দিয়ে অবাক হয়ে বলবে- ‘এই তোমার ডেকে নেবার সময় হলো?’ আমি অবাক তাকিয়ে রইবো বলে অপেক্ষায় থাকি।

সেই জলের হাওয়া নেই অদ্রি। নিঘাধ শুকনো দাঁড়িয়ে থাকি। আমার এখন কিছুই ভালো লাগে না। বিরক্ত নিজের জীবনের প্রতি। অথচ এমন কথা ছিলো না। যোগাযোগ হয়তো হবে না কয়েকদিন। ছুঁয়ে হয়তো দেখবো না উত্তর মেরুর হিম। সুবাস টেনে নিবো না শিউলির শুভ্রতায় অনাঘ্রাত কুসুম। কৈ আর হয় বলো? তুমি বাসা বদলাবে বলে একদম যোগাযোগটাই বন্ধ করে রাখলে। ফোনের এক নাম্বার দিয়েছো যার অপারেটর বড্ড বেরসিক; বারবার তোতাপাখির বুলি আউড়ে যায়— ‘লিভ আ মেসেজ- লিভ আ মেসেজ’। আমার যন্ত্রের কাছে হেরে যেতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না উড়ে যাই তোমার ঠিকানায়, কি করেই বা যাবো বলো? তোমার যে ঠিকানাটাই আমি জানি না। জানতে চাইনি কোনদিন। তোমার ও জানাবার প্রয়োজন অনুভূত হয়তো হয়নি। আমি অধিকার নিয়ে দাঁড়াবো না এমন শর্তেই তোমার সুখ ছিলো। আমিও অধিকার ফলিয়ে আমার হও নিবেদনের ভঙ্গিতে হাঁটু মুড়ে বসিনি কখনো তোমার জানুদেশে। তবে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে, ভালো লাগে ট্রেনের হুইসেল, স্টিমারের ভেঁপু রিক্সার টুং টাং। মাঝেমধ্যে নস্টালজিক হয়ে পরি, গেটের কাছে কোন গাড়ি এসে দাঁড়ালে টিকটিকিটার ভয় কাঁপানো দু:সময় দুরুদুরু মনের ওঙ্কারে গুনগুনে গীত গায়- ‘এই বুঝি এলে মোর দ্বারে।’ হয় না, মেলেনা মিলানো। তবু অপেক্ষায় থাকি।

ভাবনায় ভেসে যাই, তবু গোধূলির লালিমা কখনোই ঘর পোড়া গরুর কথা মনে করিয়ে দেয়নি। জানি ঝাড়ের ভাষায় ক্ষমা নেই। জানি নি তবু তোমার মন। ডুব দিয়ে স্নান করা হলো না তোমার দীঘির জলে। হবে হয়তো কোন একদিন। অপেক্ষায় থাকি। গ্রীবাভঙ্গির সন্ত্রাসে ভেরি বাজে, গনগীত অস্ত্রের গান, ত্রস্ত জনপদ দৌড়ে পালায়, রক্ত প্ররোচনার বসন্তে নির্মেঘ বজ্রে যে বাজে; তাহাকে এখন সম্যক চিনি না। আমি খুঁজে পাইনি সে পথ যে পথে গিয়েছে চলে সব সন্ত। ভ্রান্তি জাগে মনে, হৃদয়ে কুহক-পঞ্চম দ্বন্দ্ব, একলা একা ঘুরেছিলাম জনান্তিকে, রাজপথের চৌমাথা, ঝরা-পাতার বিজ্ঞপ্তি ফলকে। বোঝেনি কেউ প্রার্থনার শরণ তাই আমিও বুঝিনি নারী মন। সে আজো আঁকাবাঁকা-ভঙ্গুর। রাতের গভীরে এখনও সেজদার মাজারে ডুব দেয় পুণ্যশ্লোক; রূপ ছিটকে পড়ে, রূপ তোমার ভয়াতুর- লঘু করে যা ধমনীর সঞ্চালন। অনুভব করি, চিৎকার করে কান্না করি বাথরুমে বা একলা থাকার নির্বাসনে, কখনো জোছনার ছাদে, রমণের গভীরতর কোমায়। কোন কোন বৃষ্টিরদিন অনেক দীর্ঘ হয়, হয়তো সে সময়ের মাঝে দীর্ঘতম আলোর দিনটিও অনুপ্রবেশ করে সুখের কান্নায়। আলোর দীর্ঘতায় প্রকৃতি উত্তপ্ত হয়, তবু সে দিন বৃষ্টিপাত হয় অনেক দীর্ঘ সময়, যতক্ষণ মেঘ-কান্নার জল থাকে। আমি অপেক্ষায় থাকি।

অমিত্রাক্ষরদের বাড়ির পাশ ঘেঁষা যে আল পথটি আছে সেখানে দিয়ে বাক্যের দীর্ঘ পথ হেঁটে গেলেই গঞ্জের পাশে গড়ে ওঠা নতুন কবিতাদের গ্রামে যাওয়া যায়, সজনে গাছটা তখন পথের পাশে থেকে বেশ ছায়া দেয়, গাছের বোঁটা থেকে সজনের মতো দীর্ঘ পঙক্তিগুলো ঝুলে থাকে— ‘ভালোবাসা তোমায় ভালোবাসি।’ আমি শব্দের ছায়ায় সময় পেলেই বিশ্রাম করি আর... আর অপেক্ষায় থাকি, তুমি ডেকে নিয়ে বলবে আমার হও। আমি অপেক্ষায় আছি অদ্রি।